পয়লা বৈশাখ - কবীর চৌধুরী

পয়লা বৈশাখ - কবীর চৌধুরী - 1st Boishakh- Kabir Chowdhury

 

লেখক পরিচিতি

জাতীয় অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ, লেখক, সংস্কৃতি ও সমাজকর্মী কবীর চৌধুরী ১৯২৩ সালের ৯ ফেব্রæয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন খান বাহাদুর আবদুল হালিম চৌধুরী ও মাতা আফিয়া বেগম। তাঁর পৈতৃক নিবাস নোয়াখালীর চাটখিল থানার গোপাইরবাগ গ্রামের মুন্সীবাড়ি। তাঁর স্ত্রী মেহের কবীর ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক। কবীর চৌধুরী ১৯৩৮ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রবেশিকায় সপ্তম স্থান ও ১৯৪০ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৩ সালে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক সম্মান ও ১৯৪৪ সালে স্নাতকোত্তর উভয়টিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক লাভ করেন। তিনি বিভিন্ন সরকারি কলেজের অধ্যাপক, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ও সভাপতিসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও সমাজসেবামূলক কর্মকান্ডে নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৯৮ সালে তাঁকে জাতীয় অধ্যাপকের মর্যাদায় ভূষিত করা হয়। তিনি শিক্ষাবিদ প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর রচিত, সম্পাদিত ও অনূদিত গ্রন্থের সংখ্যা দুই শতেরও বেশি। একদিকে বাঙালি পাঠকদের বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত করে তোলা এবং অন্যদিকে বাংলা সাহিত্যকে ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমে বিদেশি পাঠকদের সামনে তুলে ধরা ছিলো তাঁর অনুবাদকর্মের অনন্য দিক। কবীর চৌধুরী আজীবন ছিলেন প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক মতবাদে বিশ্বাসী ও অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রবক্তা। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও একুশে পদকসহ দেশে-বিদেশে বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন। কবীর চৌধুরী ২০১১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। 

তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা : অবিস্মরণীয় বই, ছয় সঙ্গী, প্রাচীন ইংরেজি কাব্য সাহিত্য, আধুনিক মার্কিন সাহিত্য, সাহিত্য কোষ, পুশকিন ও অন্যান্য, অসমাপ্ত মুক্তিসংগ্রাম ও অন্যান্য, নজরুল দর্শন, ছোটদের ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধু, নির্বাচিত প্রবন্ধ, বিবিধ রচনা, মানুষের শিল্পকর্ম, স্মৃতিকথা, বাংলাদেশের উৎসব: নববর্ষ প্রভৃতি।


ভূমিকা

কবীর চৌধুরীর ‘পয়লা বৈশাখ’ রচনাটি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের উৎসব : নববর্ষ’ (২০০৮) নামক গ্রন্থ থেকে সংকলন করা হয়েছে, যা মোবারক হোসেন সম্পাদনা করেন। সর্বজনীন উৎসব হিসেবে পয়লা বৈশাখের গুরুত্ব ও তাৎপর্য এখানে তুলে ধরা হয়েছে। নববর্ষের ইতিহাস ও বাংলা নববর্ষের সাথে বাঙালি জাতীয়তাবোধের ঐক্যসূত্র সম্পর্কে লেখক এখানে ধারণা দিয়েছেন। 

মূলপাঠ

প্রায় সব দেশে, সব জনগোষ্ঠীর মধ্যে, সব সংস্কৃতিতেই নববর্ষ উদ্যাপনের প্রথা প্রচলিত আছে। অবশ্য উদ্যাপনের রীতি-প্রকৃতি ও পদ্ধতি-প্রকরণের মধ্যে তারতম্য আছে, তবু সর্বক্ষেত্রেই একটি মৌলিক ঐক্য আমাদের চোখে পড়ে। তা হল নবজন্ম বা পুনর্জন্ম বা পুনরুজ্জীবনের ধারণা, পুরানো জীর্ণ এক অস্তিত্বকে বিদায় দিয়ে সতেজ সজীব নবীন এক জীবনের মধ্যে প্রবেশ করার আনন্দানুভূতি। টেনিসন যখন বলেন :

রিং আউট দি ওল্ড, রিং ইন দি নিউ,

রিং, হ্যাপি বেলস্ এ্যাক্রস দি স্নো :

দি ইয়ার ইজ গোয়িং, লেট হিম গো,

রিং আউট দি ফল্স, রিং ইন দি ট্রু 

তখন তার মধ্যে আমরা সেটা লক্ষ করি। কবি রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন :

এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।

তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,

বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক \

যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,

অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক \

মুছে যাক গøানি ঘুচে যাক জরা,

অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।

রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি,

আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ।

মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক \

তখন তার মধ্যে আমরা সেটা লক্ষ করি। একজন বলেছেন, পয়লা জানুয়ারিকে উদ্দেশ্য করে, আরেকজন লিখেছেন পয়লা বৈশাখকে মনের মধ্যে রেখে, কিন্তু কেন্দ্রীয় ভাবটি উভয়ক্ষেত্রেই এক। পয়লা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ বাঙালির এক অনন্য উৎসব, তার অন্যতম জাতীয় উৎসব। এর ঐতিহ্য সুপ্রাচীন ও গৌরবমন্ডিত। আবশ্য কালের যাত্রাপথ ধরে এর উদ্যাপন রীতিতে নানা পালাবদল ঘটেছে, বিভিন্ন সময়ে তা বিভিন্ন মাত্রিকতা অর্জন করেছে। সুদূর অতীতে এর সঙ্গে কৃষি সমাজের যোগসূত্র ছিলো অবিচ্ছেদ্য। প্রাচীন কৃষি সমাজের শীতকালীন নির্জীবতার পর নবজীবনের আবির্ভাবের ধারণার সঙ্গে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের বিষয়টি সম্পর্কিত ছিলো, একথা ভাবা অসঙ্গত নয়। এক সময় গ্রাম-নগর নির্বিশেষে বাংলা সব মানুষ, সে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ কি খ্রিস্টান হোক, বাংলা নববর্ষের উৎসবে সোৎসাহে যোগ দিতো। পরস্পরের বাড়িতে যাওয়া-আসা, শুভেচ্ছা, বিনিময়, খাওয়া-দাওয়া, নানা রকম খেলাধুলা ও আনন্দ উৎসব, মেলা ও প্রদর্শনী মিলে সারা বছরের অন্যান্য দিনগুলি থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র হয়ে এই দিনটি গৌরবমন্ডিত হয়ে উঠতো। সাড়ে তিনশ’ বছরেরও বেশি আগে বিখ্যাত ঐতিহাসিক আবুল ফজল তাঁর ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে বাংলা নববর্ষকে এদেশের জনগণের নওরোজ বলে উল্লেখ করেছেন। অবশ্য তারও বহু শতবর্ষ আগে থেকে বাংলা মানুষ নানাভাবে এই দিনটি পালন করে আসছে।

কিন্তু পালা বদলের কথা বলছিলাম। উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাজত্বের দিনগুলোর এক পর্যায়ে বাংলা নববর্ষ পালনের মধ্যে এদেশের শোষিত ও পরশাসিত জনগণের চিত্তে স্বাদেশিকতা ও জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতিফলন ঘটেছিল, যদিও সে সময়কার মুসলিম মানসে এর কোনো গভীর বা প্রত্যক্ষ অভিঘাত লক্ষ করা যায় না। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনকে অবলম্বন করে তার জাতীয়তাবাদী অনুষঙ্গের সঙ্গে যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনা যুক্ত হয়েছিলো, একটু লক্ষ করলেই তা বোঝা যায়। ১৯৪৭-এ উপমহাদেশ বিভক্তির ফলে পাকিস্তান সৃষ্টির পর সেদিনের পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন নিয়ে তৎকালীন নয়া উপনিবেশবাদী, ক্ষীণদৃষ্টি, ধর্মান্ধ, পাকিস্তানি শাসকবর্গ যে মনোভাব প্রদর্শন করেন তা একইসঙ্গে কৌতূহলোদ্দীপক ও ন্যাক্কারজনক। তখন এ অঞ্চলের শিক্ষিত মানুষ ধর্ম ও সম্প্রদায় নিরপেক্ষভাবে একটি প্রতিবাদী মনোভাব নিয়ে পরম উৎসাহ ভরে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করেছে। এর মধ্যে দিয়ে তারা তাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে তুলে ধরেছে, তাদের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয় ঘোষণা করেছে, তাদের দীর্ঘদিনের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের প্রতিফলন ঘটিয়েছে।

আজ স্বাধীন বাংলাদেশেও এই দিনটি নানা কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। ব্যবসায়ী মহলে হালখাতা ও মিঠাই বিতরণের অনুষ্ঠান তো আছেই। তার পাশাপাশি আছে নানা ধরনের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, প্রদর্শনী ও মেলার আসর, সঙ্গীতানুষ্ঠান, কবিতা আবৃত্তি, আলোচনা সভা, বক্তৃতা-ভাষণ ইত্যাদি। তবে যে গ্রামবাংলা ছিলো পয়লা বৈশাখের আনন্দানুষ্ঠানের প্রাণকেন্দ্র আজ অর্থনৈতিক কারণে শহরে, বিশেষভাবে রাজধানী ঢাকায়, পয়লা বৈশাখকে উপলক্ষ করে এখন যে চাঞ্চল্য ও আনন্দ-উৎসব দেখা যায় তা নিতান্তই মেকি একথা বলা যাবে না, কিন্তু তার মধ্যে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত নাগরিকের বুর্জোয়া বিলাস ও ফ্যাশনের একটি বড় অংশ কাজ করছে সেকথা মানতেই হবে। পয়লা বৈশাখকে এ অবস্থা থেকে উদ্ধার করা প্রয়োজন। বৃহত্তর জনজীবনের সঙ্গে, শ্রমজীবী মানুষের আন্তরসত্তার সঙ্গে এর রাখীবন্ধনকে আবার নতুন করে বাঁধতে হবে। সেই লক্ষ্যে আমাদের আজ বাংলা নববর্ষের মধ্যে সচেতনভাবে নতুন মাত্রিকতা যোগ করতে হবে। বাংলা নববর্ষের উৎসব যে বিশেষভাবে ঐতিহ্যমন্ডিত, শ্রেণিগত অবস্থান নির্বিশেষে, সাধারণ মানুষের উৎসব, এর একান্ত ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র যে অত্যন্ত তাৎপর্যময় আজ সেকথাটা আবার জোরের সঙ্গে বলা চাই। নিজেকে একবার একজন হিন্দু, বৌদ্ধ কিংবা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে ভেবে দেখুন, তাহলেই এর শভিনিস্টিক দিকটি বুঝতে পারবেন।

অথচ এ অঞ্চলের ঐতিহ্য তো তা নয়। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী বেনিয়া শক্তির সামনে স্বাধীন বাঙলার সূর্য ডুবে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে সিরাজদ্দৌলা শেষ বারের মতো লড়াই করার জন্য ডাক দিয়েছিলেন হিন্দু-মুসলমান উভয়কে। আমাদের ঐতিহ্য তো মীর মদন ও মোহন লালের, তিতুমীর ও মঙ্গল পান্ডের, গোবিন্দ দেব ও মুনীর চৌধুরীর। তবে কেন এখন এর রকম ঘটছে? 

পাকিস্তানি আমলের ধর্মের নামে নৃশংসতার ইতিহাস ভুলে যাওয়া কি এতই সহজ?

বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাকে অপরাজেয় শক্তি ও মহিমায় পূর্ণ করুক, এক হোক আমাদের শুভ কামনা। জয় পয়লা বৈশাখ।  


নির্বাচিত শব্দের অর্থ ও টীকা :

অনুষঙ্গ- প্রসঙ্গ; সম্বন্ধ। অপরাজেয়- পরাভূত করা যায় না এমন। অবিচ্ছেদ্য- বিযুক্ত বা খন্ডিত করণের অযোগ্য। আইন-ইআকবরী- বিখ্যাত ঐতিহাসিক আবুল ফজল রচিত গ্রন্থ। আন্তরসত্তা- অকৃত্রিম অস্তিত্ব। উপনিবেশ- জীবিকা নির্বাহের জন্য অথবা স্থায়ীভাবে বাস করার জন্য দলবদ্ধভাবে বিদেশে যে বসতি স্থাপন করা হয়; Colony. ঐতিহ্য- লোকপ্রসিদ্ধি; পরম্পরাগত কথা। ঔপনিবেশিক- উপনিবেশ স্থাপনকারী। কৌতূহলোদ্দীপক- যাতে কোনো অজানা বিষয় জানার আগ্রহ বাড়ে। ক্ষীণদৃষ্টি- সংকীর্ণ দৃষ্টি। গৌরবমন্ডিত- মহিমাময়; মর্যাদাপূর্ণ। জাতীয়তা- স্বজাতিপ্রীতি সংক্রান্ত। নওরোজ- নতুন দিন। পারস্য দেশের নিয়ম অনুযায়ী নতুন বছরের প্রথম দিন। নির্জীবতা- প্রাণশূন্যতা। নৃশংসতা- নিষ্ঠুরতা। ন্যাক্কারজনক- অত্যন্ত নিন্দনীয়; ধিক্কারজনক। প্রত্যক্ষ অভিঘাত- সরাসরি আঘাত; এখানে তাৎক্ষণিক পরিবর্তন প্রসঙ্গে। বুর্জোয়া বিলাস- উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের শখ। রাখিবন্ধন- শ্রাবণ পূর্ণিমায় প্রিয়জনের ডান হাতে মঙ্গল কামনায় রাখি বেঁধে দেওয়ার উৎসব। শভিনিস্টিক- রুশ রাজনৈতিক মতবাদী। স্বতন্ত্র- ভিন্ন; পৃথক; স্বাধীন। সংস্কৃতি- কৃষ্টি। সামাজিক প্রকৌশলী- সমাজবিনির্মাণের কারিগর। সাম্রাজ্যবাদ- পররাজ্যের ওপর কর্তৃত্ববিস্তাররূপ রাজনৈতিক কূটকৌশল। স্বাদেশিকতা- দেশপ্রেমিকতা; সোৎসাহ- উৎসাহের সঙ্গে; আগ্রহসহকারে। হালখাতা- নতুন বছরের হিসাবনিকাশের জন্য নতুন খাতা আরম্ভের উৎসব।


সারসংক্ষেপ :

নববর্ষের একটা বিশ্বজনীন আকাক্সক্ষা হল: পুরনোকে বিসর্জন দিয়ে নতুনকে স্বাগত জানানো। বাংলা নববর্ষও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের ইতিহাস অতি প্রাচীন। একসময় কৃষি-উৎপাদনের সঙ্গে এর সম্পর্ক ছিল। নববর্ষে নানা ধরনের উৎসবের আয়োজন হত। সময়ের পালাবদলে এর সঙ্গে রাজনৈতিক দিকও যুক্ত হয়। পাকিস্তানি শাসকপক্ষ বাংলাদেশের মানুষের নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা রুদ্ধ করতে চেয়েছিল। কিন্তু বাধা পেয়ে এ উদ্যাপন আরো তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। শোষণ আর পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের হাতিয়ার হয়ে ওঠে বাংলা নববর্ষ। বাংলা নববর্ষের যে একটা চমৎকার অসাম্প্রদায়িক দিক আছে, সে কথা মনে রাখলে আমাদের নববর্ষ পালন আরো বেশি গুরুত্ববহ হয়ে উঠবে।


সৃজনশীল প্রশ্ন-১

সেই বাংলাদেশ ছিল সহস্রের একটি কাহিনি

কোরানে পুরাণে শিল্পে, পালা পার্বণের ঢাকে ঢোলে

আউল বাউল নাচে; পূণ্যাহের সানাই রঞ্জিত

রোদ্দুরে আকাশতলে দেখ কারা হাটে যায়, মাঝি

পাল তোলে, তাঁতি বোনে, খড়ে ছাওয়া ঘরের আঙনে।

ক. ‘স্বাদেশিকতা’ শব্দের অর্থ কী?

খ. ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা বলতে কী বোঝায়?

গ. উদ্দীপক ও ‘পয়লা বৈশাখ’ প্রবন্ধের মধ্যে কী সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়? Ñআলোচনা করুন।

ঘ. “উদ্দীপকে বর্ণিত চিত্রই যেন শোভা পায় বাঙালির পয়লা বৈশাখ উদযাপনে।” Ñ‘পয়লা বৈশাখ’ প্রবন্ধের আলোকে মন্তব্যটি বিচার করুন। 


নমুনা উত্তর : সৃজনশীল প্রশ্ন

সৃজনশীল অংশ-১ এর নমুনা উত্তর :

ক. ‘স্বাদেশিকতা’ শব্দের অর্থ দেশপ্রেম।

খ. ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা হচ্ছে ভেদাভেদহীন ধর্ম চেতনা। যে চেতনা একক কোন ধর্মকে গুরুত্ব না দিয়ে সকল ধর্মের উদার চর্চায় বিশ্বাস করে।  বাঙালির বাংলা নববর্ষ উদযাপন একটি ধর্ম নিরপেক্ষ সর্বজনীন উৎসব। এই উৎসবে জাতি, ধর্ম, গোত্র, উঁচু-নিচু, সাদা-কালো কোনো ভেদাভেদ করা হয় না। গ্রাম-নগর নির্বিশেষে বাংলাদেশের সব মানুষ, সে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ- খ্রিস্টান যে ধর্মেরই হোক না কেন সবাই বাংলা নববর্ষের উৎসবে একসাথে অংশগ্রহণ করে। বিগত বছরের দুঃখ-কষ্ট ও বেদনার স্মৃতি মুছে ফেলে নব আনন্দে মেতে ওঠে সবাই। তারা পরস্পর পরস্পরের আনন্দ ও কল্যাণে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বরণ করে নেয় বাংলা নববর্ষকে।

গ. বিচিত্র সাজে সজ্জিত হয়ে নানা বয়স, ধর্ম ও শ্রেণি-পেশার মানুষের সর্বজনীন এক জাতীয় উৎসবে অংশগ্রহণের বিষয়টিতে উদ্দীপকের বর্ণনার সঙ্গে ‘পয়লা বৈশাখ’ প্রবন্ধের সাদৃশ্য দেখা যায়।  পয়লা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব। একসময় গ্রাম-নগর নির্বিশেষে পরস্পরের বাড়িতে যাওয়া-আসা, শুভেচ্ছা বিনিময়, খাওয়া-দাওয়া, নানা রকম খেলাধুলা, আনন্দ উৎসব, মেলা ও প্রদর্শনী মিলিয়ে এ দিনটি আনন্দমুখর হয়ে উঠত। ‘পয়লা বৈশাখ’ প্রবন্ধে নববর্ষের দিন বাঙালির পালন করা উৎসবের কথা বলা হয়েছে। সবাই একসঙ্গে অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই উৎসবে আনন্দ করে। পক্ষান্তরে উদ্দীপকেও বাঙালির উৎসবের কথা বলা হয়েছে। উদ্দীপকে দেখা যায় বাঙালির পালা-পার্বণে ঢাক- ঢোল বাজে। পূণ্যাহের উৎসবে সকলে মিলে একসঙ্গে আনন্দে মেতে উঠে। এদিক থেকে উদ্দীপকের বর্ণনা ও ‘পয়লা বৈশাখ’ প্রবন্ধের উৎসবের মিল রয়েছে। রঙ-বেরঙের নানা সাজ-সজ্জার ক্ষেত্রেও উদ্দীপক ও‘পয়লা বৈশাখ’ প্রবন্ধের মধ্যে মিল পাওয়া যায়।

ঘ. উদ্দীপকের চিত্র ও ‘পয়লা বৈশাখ’ প্রবন্ধের উৎসবের মধ্য দিয়ে জাতীয় চেতনার প্রকাশ হয়েছে।  একটি জাতির সকল মানুষ যখন বিশেষ কোনো চেতনাকে ধারণ করে তখন তাকে জাতীয় চেতনা বলা হয়। এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সবাই একসঙ্গে মিলিত হয়। বাংলা নববর্ষ বাঙালির জীবনে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় উৎসব। নববর্ষে হালখাতা, বৈশাখি মেলা ও লোকমেলার আয়োজন করা হয়। এ উৎসব কোন ধর্মের নয়, কোনো সম্প্রদায়ের নয়, এ উৎসব সকল বাঙালির।

উদ্দীপকের চিত্রে দেখা যায় নানা ধরনের মানুষ উৎসব উপলক্ষে একত্রে আনন্দ করছে। এটা তাদের জাতীয় চেতনারই বহিঃপ্রকাশ। ‘পয়লা বৈশাখ’ প্রবন্ধেও এদেশের ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি-পেশার সকল মানুষের একত্রে উৎসব পালন করার কথা বলা হয়েছে। পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে সব ধরনের মানুষ একই সঙ্গে দুঃখ-বিষাদ ভুলে গিয়ে আনন্দে মেতে ওঠে। প্রবন্ধে পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙালির একত্র হওয়ার বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। ‘পয়লা বৈশাখ’ প্রবন্ধে জাতীয় চেতনাটি উৎসবের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। উদ্দীপকের চিত্রেও উৎসবকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের মানুষের একত্রীকরণ দেখানো হয়েছে, যা জাতীয় চেতনারই বহিঃপ্রকাশ। তাই বলা যায়, উদ্দীপকের চিত্র ও ‘পয়লা বৈশাখ’ প্রবন্ধের উৎসবের মধ্য দিয়ে জাতীয় চেতনাই অনুরণিত হয়েছে। 


অ্যাসাইনমেন্ট : নিজে করুন

সৃজনশীল প্রশ্ন:

পহেলা বৈশাখ। বাংলা বর্ষের প্রথম দিন। বাঙালির উৎসবের দিন। পহেলা বৈশাখ আমাদের প্রধান জাতীয় উৎসব। প্রতিবৎসরই বিপুল জনতা আনন্দ ও উচ্ছাসে এ উৎসবে অংশগ্রহণ করে। এ শুধু আনন্দের উৎসব নয়, সকল মানুষের জন্য কল্যাণ কামনারও দিন। বাঙালির নববর্ষ উৎসব অসাম্প্রদায়িক, ঐতিহ্যমন্ডিত এবং সর্বজনীন। পয়লা বৈশাখের চেতনা চিরজীবী হোক, এই আমাদের কামনা।

ক. কবীর চৌধুরী কোন ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন?

খ. ‘বুর্জোয়া বিলাস’ বলতে কী বোঝায়?

গ. উদ্দীপকের যে বিষয়গুলো ‘পয়লা বৈশাখ’ প্রবন্ধে প্রতিফলিত হয়েছে তা আলোচনা করুন।

ঘ. ‘পয়লা বৈশাখ’ প্রবন্ধের চেতনা উদ্দীপকটি কিছুটা হলেও ধারণ করেছে।’ -স্বীকার করেন কি ? আপনার মতামত দিন।

إرسال تعليق

Cookie Consent
We serve cookies on this site to analyze traffic, remember your preferences, and optimize your experience.
Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
AdBlock Detected!
We have detected that you are using adblocking plugin in your browser.
The revenue we earn by the advertisements is used to manage this website, we request you to whitelist our website in your adblocking plugin.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.
Contexto Answer Welcome to WhatsApp chat
Howdy! How can we help you today?
Type here...