নিমগাছ - বনফুল

নিমগাছ - বনফুল | Nimgach - Banaphul

 

লেখক পরিচিতি

বনফুল ভারতের বিহার রাজ্যের পূর্ণিয়ার অন্তর্গত মণিহার গ্রামে ১৮৯৯ সালের ১৯ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একাধারে কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও কবি। তাঁর প্রকৃত নাম বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়। কৈশোর থেকেই লেখালেখি শুরু করেন এবং শিক্ষকের কাছ থেকে নিজের নাম লুকোতে বনফুল ছদ্মনামের আশ্রয় নেন। তাঁর পিতা ডা. সত্যনারায়ণ মুখোপাধ্যায়। তাঁদের আদিনিবাস হুগলি জেলায়। বনফুল ১৯১৮ সালে পূর্ণিয়ার সাহেবগঞ্জ ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা, ১৯২০ সালে হাজরীবাগের সেন্ট কলম্বাস কলেজ থেকে আইএসসি এবং ১৯২৭ সালে পাটনা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করেন। মেডিক্যাল অফিসার পদে চাকরির মাধ্যমে বনফুলের কর্মজীবন শুরু এবং প্যাথলজিস্ট হিসেবে ৪০ বছর কাজ করেন। ১৯১৫ সালে সাহেবগঞ্জ স্কুলে পড়ার সময় ‘মালঞ্চ’ পত্রিকায় তাঁর একটি কবিতা প্রকাশিত হয় এবং ১৯১৮ সালে ‘শনিবারের চিঠি’তে ব্যঙ্গ-কবিতা ও প্যারডি লেখার মধ্য দিয়ে তাঁর সাহিত্যিক জীবনের সূত্রপাত ঘটে। পরে ‘প্রবাসী’, ‘ভারতী’ ও সমসাময়িক অন্যান্য পত্রিকায় তাঁর ছোটগল্প প্রকাশ হতে থাকে। তাঁর রচনায় পরিকল্পনার মৌলিকতা, আখ্যানবস্তুর সমাবেশে বিচিত্র উদ্ভাবনী শক্তি, তীক্ষ্ণ মননশীলতা এবং নানারূপ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে মানবচরিত্রের যাচাই পাঠকের বিস্ময় উৎপাদন করে। বিভিন্ন পুরস্কারসহ তিনি পদ্মভূষণ উপাধি লাভ করেন। ১৯৭৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি তারিখে কলকাতা শহরে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর প্রধান রচনা :

গল্পগ্রন্থ : বনফুলের গল্প, বাহুল্য, অদৃশ্যলোক, বিন্দুবিসর্গ, অনুগামিনী, তন্বী, ঊর্মিমালা, দূরবীন।

উপন্যাস : তৃণখণ্ড, কিছুক্ষণ, দ্বৈরথ, নির্মোক, সে ও আমি, জঙ্গম, অগ্নি।

কবিতা : বনফুলের কবিতা, ব্যঙ্গ কবিতা, চতুর্দশপদী;

জীবনী নাটক : শ্রীমধুসূদন, বিদ্যাসাগর।


ভূমিকা

‘নিমগাছ’ গল্পটি বনফুলের ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত ‘অদৃশ্যলোক’ গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে। এই গল্পে লেখক সংক্ষিপ্ত অবয়বের মধ্যে যে গভীর বক্তব্য উপস্থাপনের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তা বাংলা সাহিত্যে বিরল। এ গল্পে লেখক নিমগাছের প্রতীকের মাধ্যমে একজন গৃহকর্ম-নিপুণা বধূর জীবনবাস্তবতা তুলে ধরেছেন। নিমগাছ যেমন মানুষের নানা উপকারে আসে অথচ কেউ এর যথার্থ মূল্যায়ন করে না, তেমনি প্রাত্যহিক জীবন-সংসারের জালে আবদ্ধ বধূরও যথার্থ মূল্যায়ন হয় না।  



মূলপাঠ

কেউ ছালটা ছাড়িয়ে নিয়ে সিদ্ধ করছে।

পাতাগুলো ছিঁড়ে শিলে পিষছে কেউ!

কেউবা ভাজছে গরম তেলে।

খোস দাদ হাজা চুলকানিতে লাগাবে।

চর্মরোগের অব্যর্থ মহৌষধ।

কচি পাতাগুলো খায়ও অনেকে।

এমনি কাঁচাই ...

কিম্বা ভেঙে বেগুন-সহযোগে।

যকৃতের পক্ষে ভারি উপকার।

কচি ডালগুলো ভেঙে চিবোয় কত লোক ... দাঁত ভালো থাকে। কবিরাজরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

বাড়ির পাশে গজালে বিজ্ঞরা খুশি হন।

বলেÑ ‘নিমের হাওয়া ভালো, থাক্, কেটো না।’

কাটে না, কিন্তু যত্নও করে না।

আবর্জনা জমে এসে চারিদিকে।

শান দিয়ে বাঁধিয়েও দেয় কেউ- সে আর-এক আবর্জনা।

হঠাৎ একদিন একটা নতুন ধরনের লোক এলো।

মুগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে রইল নিমগাছের দিকে। ছাল তুললে না, পাতা ছিঁড়লে না, ডাল ভাঙলে না, মুগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে রইল শুধু। বলে উঠল,- ‘বাহ্, কী সুন্দর পাতাগুলি ... কী রূপ ! থোকা-থোকা ফুলেরই বা কী বাহার... একঝাঁক নক্ষত্র নেমে এসেছে যেন নীল আকাশ থেকে সবুজ সায়রে। বাহ্-’ খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে চলে গেল। কবিরাজ নয়, কবি।

নিমগাছটার ইচ্ছে করতে লাগল লোকটার সঙ্গে চলে যায়। কিন্তু পারলে না। মাটির ভিতরে শিকড় অনেক দূরে চলে গেছে। বাড়ির পিছনে আবর্জনার স্তূপের মধ্যেই দাঁড়িয়ে রইল সে। ওদের বাড়ির গৃহকর্ম-নিপুণা লক্ষ্ণীবউটার ঠিক একই দশা।


নর্বাচিত শব্দের অর্থ ও টীকা :

অব্যর্থ- যা বিফল হবে না। কবি- যিনি কবিতা লেখেন। কবিরাজ- যিনি গাছগাছালি পরিশোধন করে মনুষ্যরোগের চিকিৎসা করেন। কিম্বা- কিংবা। খোস দাদ হাজা চুলকানিতে লাগাবে- চুলকানির স্থানে লেপন করবে; গজালে- জন্মালে। গরম তেলে ভাজা- নিমপাতা গরম তেলে ভাজলে মচমচে হয় এবং তা খেতে খানিকটা উপাদেয় হয়। ছাল- বাকল; এখানে নিমগাছের বাকল। পঞ্চমুখ- পাঁচমুখ বিশিষ্ট; এখানে অতিরিক্ত প্রশংসা বোঝানো হয়েছে। পাতাগুলো খায়ও- নিমের কচিপাতা খেলে মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। মহৌষধ- যে ওষুধ উৎকৃষ্ট বা অব্যর্থ। বিজ্ঞ- জ্ঞানী; পণ্ডিত। শান দিয়ে বাঁধানো- এখানে ইট ও সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো বোঝাচ্ছে। শিকড় অনেক দূর চলে গেছে- প্রতীকাশ্রয়ে বর্ণিত। নিমগাছের শিকড় মাটির গভীরে প্রবেশ করে এবং চারিদিকে বিস্তৃতও হয়। লক্ষী বউটার প্রতীক যেহেতু নিমগাছ সেহেতু নিমগাছের শিকড়ের সঙ্গে বউয়ের সংসারের জালে চারিদিকে আবদ্ধ হওয়াকে বোঝানো হয়েছে। শিলে পেষা- নিমগাছের পাতা শিলপাটায় বেটে তা থেকে রস বের করা হয়। সহযোগ- মিলন; সংযোগ। সায়রে- সাগরে।


সারসংক্ষেপ :
নিম মানুষের জন্য খুবই উপকারী। মানুষ বিচিত্রভাবে তার উপকার গ্রহণও করে। কিন্তু গাছটার দিকে খুব একটা মনোযোগ দেয় না। তার অবস্থান এক কোণে - ঝোপ-জঙ্গলের মধ্যে। অনাদর-অবহেলায়ও তার কিছু করার থাকে না। গাছের তো আর নড়ার উপায় নেই। শেষের একটিমাত্র বাক্যে লেখক এই নিমগাছের তুলনা করেছেন বাড়ির বউটার সঙ্গে। বোঝা যায়, নিমগাছের ছলে তিনি আসলে বউয়ের গল্পই বলেছেন।

সৃজনশীল প্রশ্ন-১
১. মোটে এগার বছর বয়স আতর বানুর। মা-বাবা নেই। ভাই-ভাবীর সংসারে পড়ে আছে। খুব যে ভালো আছে তা নয়। উঠতে বসতে টিপ্পনি আর তিরস্কার তার নিত্য উপহার। কাজল খালা একবার ভেবেছিলেন বোনঝিকে নিজের কাছে নিয়ে মানুষ করবেন। কিন্তু আতর বানু রাজি হয়নি। রক্তসম্পর্ক ছেড়ে সে অন্য কোথাও পরগাছা হতে চায় না। কাজল খালা আতর বানুর মানসিকতা উপলব্ধি করে বিস্ময় প্রকাশ করেন।
ক. নিমগাছটার কার সঙ্গে চলে যেতে ইচ্ছা করল?
খ. কবিরাজরা নিমগাছের প্রশংসায় পঞ্চমুখ কেন?
গ. উদ্দীপকের আতরবানুর সঙ্গে ‘নিমগাছ’ গল্পে কার সাদৃশ্য রয়েছে? -আলোচনা করুন।
 ঘ. “উদ্দীপকের কাজল খালার ভূমিকা ‘নিমগাছ’ গল্পের কবির মতোই।” -মন্তব্যটি বিচার করুন। 

নমুনা উত্তর : সৃজনশীল প্রশ্ন
সৃজনশীল প্রশ্ন-১-এর নমুনা উত্তর :

ক. নিমগাছটার কবির সঙ্গে চলে যেতে ইচ্ছা করল।

খ. নিমগাছের নানারকম ভেষজ গুণ রয়েছে। তাই কবিরাজরা এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন।  নিমগাছ কার্যকর এক ভেষজ উদ্ভিদ। এর বিভিন্ন অংশ রোগ নিরাময়ের কাজে লাগে। নিম গাছের ছাল সিদ্ধ করে বা পিষে চর্মরোগের ওষুধ তৈরি করা হয়। নিমের কচিপাতা খেলে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে, যকৃতের উপকার হয়। নিমের কচি ডাল চিবানোয় দাঁতের স্বাস্থ্য ভাল থাকে। এতসব উপকারী গুণের কারণেই কবিরাজরা নিমগাছের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকেন।

গ. উদ্দীপকের আতর বানুর সঙ্গে ‘নিমগাছ’ গল্পের লক্ষী বউটার সাদৃশ্য রয়েছে।  সমাজে সবসময় দুই শ্রেণির লোক দেখা যায়। এক শ্রেণির লোক কেবল উপকার ভোগ করে। আর এক শ্রেণির লোক আছে যারা কেবল সমাজ ও সংসারের জন্য প্রাণপাত করে। তারা নিজের চারপাশের পৃথিবীকে সুন্দর করে তোলেন। এ ধরণের লোক নিজেদের শিকড়কে ছাড়তে চান না। ‘নিমগাছ’ গল্পে আমরা এ বিষয়টি দেখতে পাই।  আতর বানু পিতামাতা হারানোর পর ভাইয়ের সংসারে অনেকটা অবাঞ্ছিতের মত বড় হতে থাকে। উঠতে বসতে তাকে তিরস্কার আর টিপ্পনি সহ্য করতে হয়। আতর বানু মনে করে ভাই-ভাবির সংসারের সাথে তার রক্তের সম্পর্ক। সেজন্য আতর বানু অবহেলা আর অযত্নের পরও সংসারের বাঁধন ছিন্ন করে চলে যেতে পারে না। এমনকি কাজল খালার অনুরোধও সে প্রত্যাখ্যান করে। তেমনি নিমগাছ গল্পের লক্ষী বউটি সংসারে সবার সেবায় নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দেয়। কিন্তু সংসারের কেউই তার যত্ন বা সুযোগ-সুবিধার কথা ভাবে না। তবু সংসারের প্রতি মায়া ও অচ্ছেদ্য সম্পক অনুভব করে বলে সব ছেড়ে দূরে চলে যেতে পারে না। এভাবে আমরা উদ্দীপকের আতর বানুর সঙ্গে চেতনাগত দিক থেকে ‘নিমগাছ’ গল্পের লক্ষী বউটির সাদৃশ্য দেখতে পাই। 

ঘ. উদ্দীপকে কাজল খালা ও ‘নিমগাছ’ গল্পে কবির অবস্থান ভিন্ন রকম দেখা যায়। কারণ কাজল খালা আতর বানুর দুর্দশা দূর করার চিন্তা করেছেন। আর কবি কেবল গাছের সৌন্দর্য উপভোগ করেছেন।  মানুষ সমাজে বসবাস করে। কিন্তু এই সামাজিক মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি সকলের একরকম হয় না। কারো আচরণে থাকে মানবিক বিষয়, আর কেউবা শুধু সৌন্দর্যপিয়াসী। ‘নিমগাছ’ গল্প এবং উদ্দীপকে এরকম দুটি বিষয়ই প্রকাশিত হয়েছে।  ‘নিমগাছ’ গল্পে সকলেই নিমগাছের নিকট থেকে উপকার পেতে চায়। নিমগাছের দুঃখের কথা কেউ ভাবে না। কিন্তু একদিন একজন ব্যতিক্রমধর্মী লোক এলেন। তিনি কবিরাজ নন, কবি। কবি সৌন্দর্যের দৃষ্টিতে নিমগাছের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হলেন। তিনি নিমগাছের পাতা ছিঁড়েন নি, ডাল ভাঙেননি বা ছালও তোলেননি। তিনি শুধু নিমগাছের রূপের সুধা পান করেছেন। উদ্দীপকে দেখা যায় আতর বানু বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর অনাদর-অবহেলায় সংসারের দিন অতিবাহিত করছিল, কাজল খালা এসে আতর বানুর দুর্দশা দেখে তাকে তার সঙ্গে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। ‘নিমগাছ’ গল্পের কবি ও উদ্দীপকের কাজল খালা একই রেখায় অবস্থান করেননি। কবি কেবল নিমগাছের রূপ ও সুধা পান করেছেন, নিমগাছের সেবা বা যতেœর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। পক্ষান্তরে, কাজল খালা নিজে আতর বানুর দায়িত্ব নিতে চেয়েছেন। আতর বানুকে তিনি নিজের কাছে রেখে মানুষ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। তাই, আমরা বলতে পারি উদ্দীপকের কাজল খালা ও ‘নিমগাছ’ গল্পে কবির অবস্থান সমপর্যায়ের নয়। 

অ্যাসাইনমেন্ট : নিজে করুন
সৃজনশীল প্রশ্ন :
আমি একটি পাকুড় গাছ। জন্ম কোথায় কোন কালে আমার জানা নেই। দিগন্তবিস্তারী আমার শাখাপ্রশাখা। আমার শেকড়বাকড় মাটির অনেক গভীরে বিস্তৃত। ক্লান্ত পথিক শ্রান্তি ফিরিয়ে নেয় আমার সুশীতল ছায়ায়। আমি ছায়া দিই, বাতাস দিই
মানুষকে। কিন্তু কেউ কেউ আমার গায়ে গর্ত করে, ডাল ভেঙে ফেলে। আমি কষ্ট পাই। একদিন আমার কাছে একটা লোক
আসে। আমার দিকে চেয়ে থাকে অপলক দৃষ্টিতে। বলে, ‘পৃথিবীর যত শান্তি এখানে।’ আমি বুঝি, এ অন্য জাতের মানুষ।
ক. বনফুল কোন আঙ্গিকে গল্প লিখতেন?
খ. ‘কাটে না, কিন্তু যতœও করে না।’ -ব্যাখ্যা করুন।
গ. উদ্দীপকের পাকুড়গাছের সঙ্গে ‘নিমগাছ’ গল্পের নিমগাছের সাদৃশ্য বর্ণনা করুন।
ঘ. “উদ্দীপকটি ‘নিমগাছ’ গল্পের অন্তর্নিহিত ভাব নয় বরং একটি বিশেষ অবস্থাকে তুলে ধরেছে।” -আলোচনা করুন।

Post a Comment

Cookie Consent
We serve cookies on this site to analyze traffic, remember your preferences, and optimize your experience.
Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
AdBlock Detected!
We have detected that you are using adblocking plugin in your browser.
The revenue we earn by the advertisements is used to manage this website, we request you to whitelist our website in your adblocking plugin.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.
Contexto Answer Welcome to WhatsApp chat
Howdy! How can we help you today?
Type here...