হিট্টাইট সভ্যতা কী?

 


হিট্টাইট সভ্যতা ছিল একটি প্রাচীন সাম্রাজ্য যা আনাতোলিয়া (বর্তমান তুরস্ক) অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল। এটি খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ১৬০০-১২০০ সালের মধ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধ ছিল এবং প্রাচীন নিকটপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ শক্তিগুলোর মধ্যে একটি হয়ে উঠেছিল।  


হিট্টাইট সভ্যতার প্রধান বৈশিষ্ট্য  

১. অবস্থান ও সময়কাল  

  • অবস্থান: বর্তমান তুরস্কের মধ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল। এর রাজধানী ছিল হাট্তুসা (বর্তমান বোগাজকোয়)।  
  • সময়কাল:  খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ সালের দিকে গড়ে ওঠা।   খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ সালের দিকে "ব্রোঞ্জ যুগের পতন" নামে পরিচিত একটি সংকটের সময়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত।  

২. রাজনীতি ও প্রশাসন  

  • এককেন্দ্রিক সাম্রাজ্য: হিট্টাইটরা একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলে।  
  • রাজা: হিট্টাইট রাজারা রাজনৈতিক নেতা এবং ধর্মীয় প্রধান হিসেবে কাজ করতেন।  
  • চুক্তির প্রথা: হিট্টাইটরা প্রথম আন্তর্জাতিক চুক্তি প্রণয়নকারী সভ্যতাগুলোর একটি। খ্রিস্টপূর্ব ১২৭৪ সালে "কাদেশের চুক্তি" হিট্টাইট এবং মিশরের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়। এটি ইতিহাসের প্রথম লিখিত শান্তি চুক্তি হিসেবে পরিচিত।  

৩. ধর্ম ও সংস্কৃতি  

  • বহু-দেবতাবাদ (Polytheism): তারা বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা করত, যেমন সূর্যের দেবী আরিনা এবং ঝড়ের দেবতা তেশুব।  
  • ধর্মীয় সহনশীলতা: হিট্টাইটরা তাদের বিজিত অঞ্চলগুলোর দেবতাদেরও গ্রহণ করত।  

লিখন পদ্ধতি:  

    • হিট্টাইটরা আক্কাদীয় কিউনিফর্ম এবং নিজস্ব হিয়ারোগ্লিফিক লিপি ব্যবহার করত।  
    • হিট্টাইট ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলোর প্রাচীনতম উদাহরণগুলোর একটি।  

৪. অর্থনীতি ও প্রযুক্তি  

  • লৌহ যুগের প্রবর্তক: হিট্টাইটরা প্রথম লৌহ ধাতুর ব্যবহারের ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করে, যা তাদের সামরিক এবং অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করে।  
  • কৃষি ও পশুপালন: হিট্টাইট অর্থনীতি প্রধানত কৃষি এবং পশুপালনের উপর নির্ভরশীল ছিল।  
  • বাণিজ্য: তারা মেসোপটেমিয়া এবং মিশরের মতো শক্তিগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য করত।  


৫. সামরিক শক্তি  

  • রথযুদ্ধের কৌশল: হিট্টাইটরা উন্নত রথ যুদ্ধের কৌশল প্রবর্তন করেছিল। তাদের রথ ছিল দ্রুতগতির এবং মিশরের মতো শক্তিশালী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে কার্যকর।  
  • সামরিক বিজয়: তারা সিরিয়া এবং লেভান্ট অঞ্চলে বিস্তৃত সাম্রাজ্য গড়ে তোলে।  

৬. পতনের কারণ  

  • অভ্যন্তরীণ সংঘাত: রাজ পরিবারের মধ্যে উত্তরাধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব।  
  • বাহ্যিক আক্রমণ: "সমুদ্র জনগণ" (Sea Peoples) এবং অন্যান্য শত্রুদের আক্রমণে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে।  
  • ব্রোঞ্জ যুগের পতন: জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থনৈতিক সংকট এবং সাংস্কৃতিক পতনের সম্মিলিত প্রভাব হিট্টাইট সাম্রাজ্যের পতন ঘটায়।  

হিট্টাইট সভ্যতার ঐতিহাসিক গুরুত্ব  

  • লৌহ প্রয়োগের শুরু: তাদের লৌহ প্রয়োগ প্রযুক্তি ইউরোপ এবং এশিয়ার অন্যান্য সভ্যতাগুলোতে প্রভাব ফেলেছিল।  
  • আন্তর্জাতিক সম্পর্ক: প্রথম শান্তি চুক্তির উদাহরণ এবং কূটনৈতিক কার্যক্রম।  
  • সংস্কৃতির বৈচিত্র্য: তারা বিভিন্ন সভ্যতার সঙ্গে মিশ্র সংস্কৃতি তৈরি করেছিল।  
  • প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার: হাট্তুসা থেকে প্রাপ্ত কিউনিফর্ম লিপি এবং অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন তাদের সভ্যতা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে।  

উপসংহার  

হিট্টাইট সভ্যতা তাদের সামরিক শক্তি, লৌহ প্রয়োগ এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জন্য স্মরণীয়। যদিও তাদের সাম্রাজ্য টিকতে পারেনি, তাদের অবদান ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়।